বড়বেলায় ‘জীবনস্মৃতি’ লিখতে বসে কবির মনে পড়েছে ছোটোবেলার সেই বটগাছটির কথা।
ছোট্ট রবির জানলার ঠিক নিচেই এক পুকুর। তারই পাড়ে দাঁড়িয়ে এক চীনা বট। জানলা দিয়ে পুকুর, তার চারপাশের লোকজন, তাদের যাওয়া আসা, স্নান করা দেখেই সারাটা দিন কাটত রবির। সেই বটগাছ, তার চারপাশ দেখতে দেখতে কল্পনায় ডুব দিত রবি।
বাইরে যাওয়া ছিল বারণ! বালক চাকর শ্যাম টেনে দিত গণ্ডী। তার বাইরে ...উঁহু, না ... লক্ষ্মণের গণ্ডী টানা.. এদিকে বাইরে প্রকৃতির কত না হাতছানি! কত উঁকিঝুঁকি। অসংখ্য ঝুরি নামা সেই বটগাছের মতো এমন কত ছবি, কত গল্প, রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলাটুকু জুড়ে।
বাড়িতে ছিল একটা পুরোনো পালকি। ঠাকুরমার আমলের। ওরই ভেতর ছুটির দিন বসে চলত তাঁর আপন খেয়ালে পথ চলা। কত দূর দূর দেশের ঘন বনের মধ্যে সে পথ! সেখানে ‘বাঘের চোখ জ্বলজ্বল করছে , গা করছে ছমছম’। বিশ্বনাথ শিকারীর বন্দুক ছুটতেই, ব্যাস সব চুপ’। কখনও পালকি হত একটা দ্বীপ আর রবি যেন ‘রবিনসন ক্রুসো’। পালকি কখনও ‘ময়ুরপঙ্খি’ নাও। ভেসে চলেছে সমুদ্রে।দাঁড় পড়ছে ছপছপ, ঢেউ উঠছে দুলে। তারপর ঝড় উঠল, ‘সামাল, সামাল...’। এভাবেই চলত ছোট্ট রবির ‘পালকির সফর’।
কখনও আবার লাঠি হাতে বারান্দার রেলিংগুলোকে পড়াতে বসত ছোট্ট রবি। তারা সব ছাত্র, কেউ দুষ্টু, কেউ ভালো। দুষ্টুগুলোর ওপর পড়ত লাঠির ওপর লাঠি। পরে রবি লিখবে ‘মাস্টারবাবু’ নামের ছোটদের পছন্দের সেই ছড়াটি।
রবির জন্ম সেকেলে কলকাতায়। তখন রাস্তায় চলত ‘শ্যাকড়াগাড়ি’। ট্রাম, বাস, মোটরগাড়ি কিছুই ছিল না। ‘বিজলি বাতি’র বদলে রেড়ির তেল, কেরোসিনের আলো। ভূতপ্রেত শাঁকচুন্নির ভয়। রাতের পড়ার শেষে বারমহল থেকে ভেতরে যাবার পথে ছোট্ট রবির ‘মন বলত, কি জানি কিসে বুঝি পিছু ধরেছে’।
জীবন ছিল খুব সাদামাটা। ‘চাল ছিল গরিবের মতো’। শীতকালে ‘একটা সাদা জামার ওপর আর একটা সাদা জামা’-ব্যাস। চাকর বাকরদের হাতেই ছিল সবকিছুর ভার। খাবার সাজিয়ে খেতে দেওয়া নয়, ‘একটা একটা করে লুচি আলগোছে দুলিয়ে চাকর ঈশ্বর জিজ্ঞেস করত, ‘আর দেব কি’। ‘না’ শোনাটাই ছিল তার একান্ত ইচ্ছে। দুধের ওপরেও ছিল ভালোই টান। তার ইচ্ছেতে বাদ সাধতে মন চাইত না রবির।
আবদুল মাঝি গল্প শোনাত, ঈশ্বর শোনাত কৃত্তিবাসী রামায়ণ, শ্যাম বলত ডাকাতের গল্প, কিশোরী চাটুজ্যে সুর করে আওড়াত দাশুরায়ের পাঁচালি। রাতে দিদিমার (মায়ের খুড়ি)পাশে শুয়ে রূপকথার গল্প শোনা। কখনও আবার রাত দুপুরে ঘুম থেকে উঠে যাত্রা দেখার ধুম।
রঘু ডাকাতের গল্প শুনে ভয়ে বুক ধুকপুক। কল্পনায় রবি দেখত, ‘ গল্পের আতঙ্ক জমা হয়ে আছে না-জানা মাঠের গাছতলায়, ঘন বেতের ঝোপে। ...বাঁশের লাঠির আগা দুই একটা দেখা যায় ঝোপের উপর দিকে। কাঁধ বদল করবে বেহারাগুলো ঐখানে।... তারপরে? রে রে রে রে রে রে!” এমন করে হা রে রে রে করে কারা যেন হাঁক দিয়ে উঠবে পরে ‘বীরপুরুষ’ কবিতায়।
ছেলেবেলায় দাদা আর ভাগ্নে সত্যপ্রসাদকে স্কুলে যেতে দেখে যখন কান্নাকাটি করছিল রবি, তখন এক মাস্টারমশাই কষে একটা চড় মেরে বলেছিলেন, এখন স্কুলে যাবার জন্য যেমন কাঁদছ, না যাবার জন্য এর চেয়ে অনেক বেশি কাঁদতে হবে। পরে কবি লিখেছিলেন, এর চেয়ে ‘অব্যর্থ ভবিষ্যৎবাণী’ জীবনে আর কোনোদিন শোনেন নি।
ভর্তি হয়েছিলেন ওরিয়েণ্টাল সেমিনারিতে, নর্মাল স্কুলে, বেঙ্গল একাডেমিতে। কিছুদিন স্কুলে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু ভালো লাগেনি। নানা কারণে স্কুল সম্পর্কে তৈরি হয়েছিল বিরক্তি। অনীহা। স্কুলের পড়া শেষ করেননি। এমন কি, বিলেত গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও কোন ডিগ্রি না নিয়েই ফিরে আসেন। কিন্তু নিজের ইচ্ছেমত, খেয়াল খুশির আনন্দে যা পড়েছেন, শিখেছেন তার তুলনা কোথায়? তাঁর সিলেবাসে পরীক্ষাও ছিল না, পাশ ফেলও না। ছিল বাড়ির পরিবেশ। গান, কবিতা, নাটক, অভিনয়, আলাপ আলোচনা, বাবা, দাদা, দিদি, বৌদিদের সাহচর্য।
সেজদা হেমেন্দ্রনাথ পড়াতেন রবিকে আর অন্যদের। জ্যোতিদাদার সঙ্গে বসে গান, কবিতা, নাটক লেখালেখি। আসতেন নীলকমল মাস্টার, হেরম্ব তত্ত্বরত্ন, অঘোর মাস্টার, সীতানাথ দত্ত, শ্রীকণ্ঠ বাবু, আরও কত কে। ডাকসাইটে পালোয়ানের কাছে চলত কুস্তির মারপ্যাঁচ , যদু ভট্টের কাছে তানপুরায় সুর লাগিয়ে গান, ছবি আঁকা, জিমন্যাস্টিক আরও কত কী। জ্ঞান ভট্টাচার্যের আগাগোড়া ‘কুমারসম্ভব’ মুখস্থ করানো, ‘ম্যাকবে্থে’র তর্জমা, রামসর্বস্ব পণ্ডিতের ‘শকুন্তলা’ পড়ানো। ‘আর বাংলা বইয়ের তো বাছবিচার ছিল না’।
বোলপুরে, ডালহৌসি পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে বাবাকে একান্তে পাওয়া- বাবার কাছে সংস্কৃত, উপনিষদ, মুগ্ধবোধ, ইংরিজি পড়া, আপন খেয়ালে খোয়াইয়ের রাজ্যে লিভিংস্টোন হয়ে ঘুরে বেড়ানো, নানা রকমের পাথর কুড়িয়ে ছোট্ট পাহাড় সাজানো, বাবার সস্নেহ উৎসা্হ বাক্য,- সব মিলিয়ে রবির ছেলেবেলাটা ছিল স্বপ্নের মতো। যা রবিকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার পথে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছিল।
Comments